
ফাইল ছবি
গত সপ্তাহে বেশকিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়, সংবাদমাধ্যমেও ব্যাপক প্রচারিত হয়েছে। কী ছিল সেই ছবিতে! দেবতার মুখে মাস্ক বা মুখ বন্ধনী পরানো। হাস্যকর কিংবা অবাক হলেও ঘটনা সত্যি।
ভারতের বারাণসী শহরের সিগড়াতে অবস্থিত শিব-পার্বতী মন্দিরে এমন ঘটনা ঘটে। যেখানে শিব-পার্বতীর মূর্তিসহ ভোলানাথ, দুর্গা, কালী এবং সাঁই বাবার মূর্তির মুখে মাস্ক পরিয়ে দেয়া হয়।
মন্দিরের পুরোহিত হরিশ মিশ্র সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘মন্দির কর্তৃপক্ষ ও ভক্তদের যৌথ উদ্যোগেই দেবতাদের মুখে মাস্ক পরানো হয়।’ নিতান্তই হেয়ালী বা সাধারণ ঘটনা বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে কি তাই! প্রতীকী অর্থে এই ছবির মানে কী দাঁড়ায়! পৃথিবী বর্তমানে মানুষের বসবাসের কতটা অযোগ্য হয়ে পড়েছে, যা কিনা দেবতাদেরও ছুঁয়ে গেছে।
ভারতের দিল্লি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর। প্রতি বছর দীপাবলি উৎসবের পর দিল্লির বায়ুদূষণ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছায়। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। জরুরি অবস্থা জারি করে শহরের সব স্কুল বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। প্রতি বছরের মতো এবারো মাস্ক ব্যবহার করতে বাধ্য হন সেখানকার মানুষ।
তবে ভারতের দিল্লির চেয়ে কোনো অংশে দূষণমাত্রায় কম নয় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। বায়ুদূষণের মাত্রা মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমনকি তা দিল্লিকেও মাঝে মধ্যে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক একটি গবেষণা তুলে ধরলে সহজেই বর্তমান চিত্র প্রতীয়মান হবে। পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিস ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়ালের তথ্যানুযায়ী, গত ৫ ও ৬ নভেম্বর বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে তালিকার এক নম্বরে ছিল ঢাকা। আর দ্বিতীয় অবস্থানে জায়গা করে নেয় ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। তৃতীয় অবস্থানে পাকিস্তানের লাহোর। সার্বিক দিক থেকে দূষিত রাজধানীর মধ্যে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়।
বলা হচ্ছে, বর্তমানে বছরের প্রায় ২০০ দিন ঢাকার বায়ু মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে থাকে। বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৯ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে অন্তত ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়া গড় আয়ু প্রায় ১ বছর ৩ মাস কমে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট (এইচইআই) ও ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশনের (আইএইচএমই) যৌথ উদ্যোগে সম্প্রতি প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার ক্রমবর্ধমান বায়ুদূষণযুক্ত পরিবেশে কোনো শিশু বেড়ে উঠলে তার গড় আয়ু ৩০ মাস (২.৫ বছর) পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
এছাড়া স্টেট অব গ্লোবাল এয়ারের মতে, বাংলাদেশে ৯০ শতাংশ লোক কোনো না কোনোভাবে বায়ুদূষণের মধ্যে বসবাস করে। আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, বিশ্বে বায়ুদূষণে রাজধানী হিসেব করলে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়তে। আর শহরের হিসেবে ঢাকা আছে ১৭ নম্বরে।
কেন বাড়ছে বায়ুদূষণ! অপরিকল্পিত শিল্প, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, ইটভাটা ও নির্মাণকাজে দূষণ প্রতিরোধী ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ইটভাটার কারণে সূক্ষ্ম ধূলিকণা বাতাসে মিশে যায়। নির্মাণকাজের সময় নিয়ম না মেনে মাটি, বালিসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী দীর্ঘদিন যত্রতত্র ফেলে রাখা, রাস্তার দুই পাশে ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা, সর্বোপরি যানবাহনের কালো ধোঁয়া বাতাসকে দূষিত করে তোলে।
বাতাসে বেড়ে যায় মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) বা অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণার উপস্থিতি। মানবদেহের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর পিএম ২.৫। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মান অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পিএম ২.৫-এর সহনীয় মাত্রা ১০ মাইক্রোগ্রাম। যদিও বাংলাদেশের প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পিএম ২.৫-এর পরিমাণ ৬১ মাইক্রোগ্রাম। বাতাসে সহনীয় মাত্রার অতিরিক্ত অতিসূক্ষ্ম এ বস্তুকণা স্বল্পমেয়াদে মাথাব্যথা, শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ নানা ব্যাধির জন্য দায়ী।
তবে দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাবে ফুসফুস ক্যান্সার, কিডনিসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অনেক অঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শেষ পর্যন্ত যা জীবননাশের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এইচইআই ও আইএইচএমইর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফুসফুসজনিত রোগে মৃত্যুর ৪৯ শতাংশ হয় বায়ুদূষণের কারণে। এছাড়া ডায়াবেটিসে মৃত্যুর ২২, হৃদরোগে মৃত্যুর ২৪, স্ট্রোকে মৃত্যুর ১৫ ও ফুসফুসের ক্যান্সারে মৃত্যুর ৩৭ শতাংশ ঘটে বায়ুদূষণে।
বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এয়ার কোয়ালিটি রিচার্স অ্যান্ড মনিটরিং সেন্টারের প্রকল্প ম্যানেজার এবং মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদ আখতার।
তিনি বলেন, ‘বায়ুদূষণের ঘটনা দুইভাবে ঘটে। একটি হলো ক্ষুদ্র কণিকার কারণে। আকেটি হলো নানা কেমিক্যাল ও দূষিত পদার্থের কারণে। আমাদের দেশে ক্ষুদ্র কণিকার মাধ্যমে বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি। এ বায়ুদূষণ রোধে আসলে দৃশ্যমান নয় সরকারের উদ্যোগ। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যেমন দক্ষ ও তৎপর নয়, তেমনি দূষণ পরিমাপে যেসব যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তাও তত আধুনিক নয়। সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেই বললেই চলে।’
সময় চলে যাচ্ছে, উল্লেখ করে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি বায়ুদূষণ রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানান এই পরিবেশ বিশেষজ্ঞ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বাতাসের মান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, গত চার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ঢাকায় দূষণের সময় বেড়েছে। সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত রাজধানীর বাতাস দূষিত থাকে। সবচেয়ে বেশি দূষণ থাকে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। কিন্তু গত দুই বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, মার্চ ও এপ্রিলের বাতাসও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের মতো খারাপ থাকছে।
সম্প্রতি পরিবেশ গবেষক আতিক আহসানের একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে গত কয়েক বছরে বায়ু দূষণের সার্বিক চিত্র ফুটে উঠেছে। গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৪ সালে ১৬৫ দিন ঢাকার বায়ু অস্বাস্থ্যকর থেকে মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর ছিল। ২০১৫ সালে তা বেড়ে ১৭৩ দিন, ২০১৬ সালে ১২৯ দিন, ২০১৭ সালে ১৮৫ দিন ও ২০১৮ সালে ১৯৭ দিনে গিয়ে দাঁড়ায়। এ দূষিত বায়ুতে যেসব ক্ষতিকর উপাদান আছে, তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক উপাদান হচ্ছে পিএম ২.৫।
এশিয়ার বায়ুর গুণমান অনেক খারাপ, বিশেষ করে বাংলাদেশের জনগণ ১৯৯০ সাল থেকে পিএম ২.৫ মাত্রার মধ্যে বসবাস করছে।
আতিক আহসান জানান, ঢাকার বায়ুদূষণের সময়কাল যেভাবে বাড়ছে, তাতে শহরে রোগব্যাধির প্রকোপ আরো বাড়তে পারে। এখনই বায়ু অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠলে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে বাতাস আরো ভয়ংকর হয়ে উঠবে। ফলে এখন থেকেই এটিকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের পুরো জনগোষ্ঠীই বায়ুদূষণের মধ্যে আছে। এর মধ্যে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকার মানুষ।
জাতীয় বায়ুমান অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে দৈনিক সর্বোচ্চ ১৫০ মাইক্রোগ্রাম পিএম ১০ ও ৬৫ মাইক্রোগ্রাম পিএম ২.৫ থাকতে পারে। অথচ ঢাকার বাতাসে রয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে তিন গুণ বেশি পিএম।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এক গবেষণা মতে, শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার প্রতি ঘনমিটার বাতাসে এর মাত্রা থাকে ৪৯৯ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত।
দেশের দূষণপ্রবণ এলাকাগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম উল্লেখ করে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) জিয়াউল হক বলেন, ‘গত বছর একাধিক গবেষণায় উঠে এসেছে ঢাকার চেয়ে পৃথিবীর প্রায় ১৮টি শহরের দূষণের মাত্রা বেশি। এমনকি বর্তমানে দিল্লিতে বায়ুদূষণের মাত্রা ঢাকার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। তবে বাংলাদেশের বিশেষ করে ঢাকায় বায়ুদূষণ যে বাড়ছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। দূষণের কারণগুলোও আমরা জানি। সেগুলো প্রতিরোধে পরিবেশ অধিদপ্তর জোরালোভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’
ঢাকার বায়ু দূষণের মাত্রা অসহনীয়: পরিবেশমন্ত্রী